এল চ্যাপো: মেক্সিকোর মাদক সম্রাটের অবিশ্বাস্য পালানোর গল্প
বিশ্বের ইতিহাসে কিছু কিছু অপরাধীর নাম এমনভাবে লেখা থাকে, যাদের জীবন কাহিনি যেন সিনেমাকেও হার মানায়। তেমনই একজন হলেন ‘এল চ্যাপো’ – পুরো নাম হোয়াকিন আর্চিভাল্ডো গুজম্যান লোয়েরা। মেক্সিকোর সবচেয়ে কুখ্যাত মাদক চোরাকারবারিদের মধ্যে অন্যতম, যিনি শুধু মাদক ব্যবসার জন্যই নয় বরং তাঁর একাধিক অবিশ্বাস্য পালানোর জন্যও বিশ্বজুড়ে আলোচনায় এসেছেন। আজ আমরা জানব তাঁর জীবন, মাদক সাম্রাজ্য গড়ে তোলা এবং সবথেকে চমকপ্রদ সেই পালানোর গল্প – যা সত্যি শুনলে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়!
এল চ্যাপোর শুরুটা কেমন ছিল?
হোয়াকিন গুজম্যানের জন্ম ১৯৫৭ সালে, মেক্সিকোর সান লুকাস নামের এক ছোট্ট গ্রামে। তাঁর পরিবার ছিল খুবই গরিব। ছোটবেলাতেই গুজম্যান বুঝে যান, দরিদ্রতা থেকে মুক্তি পেতে হলে অন্য পথ বেছে নিতে হবে। শুরু হয় অবৈধ পথে যাত্রা – প্রথমে স্থানীয় গাঁজা চোরাচালান, পরে কোকেইনের ব্যবসায় প্রবেশ। ১৯৮০-এর দশকে তিনি কলম্বিয়ান ড্রাগ লর্ডদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিঙ্গালোয়া কার্টেল গঠন করেন।
কীভাবে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল মাদক সাম্রাজ্য?
এল চ্যাপো ছিলেন একজন কৌশলী ও নিষ্ঠুর ব্যবসায়ী। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, মাদক পরিবহনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো গোপন সুড়ঙ্গ, তাই তিনি আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তে অসংখ্য সুড়ঙ্গ তৈরি করেন। তাঁর নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো আমেরিকা, ইউরোপ এমনকি এশিয়া পর্যন্ত। তাঁর কার্টেল হয়ে উঠে এতটাই প্রভাবশালী যে, এক সময় এল চ্যাপোর আয় বিল গেটসের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।
প্রথমবার গ্রেফতার এবং পালানো (২০০১)
১৯৯৩ সালে এল চ্যাপো প্রথমবার গ্রেফতার হন। মেক্সিকোর হাই-সিকিউরিটি জেল ‘পুয়েন্টে গ্রান্দে’ তে বন্দি করা হয়। কিন্তু এখানেও তিনি থেমে থাকেননি। জেলে থেকেও মোবাইল ফোন ও ঘুষের মাধ্যমে নিজের সাম্রাজ্য চালিয়ে যেতে থাকেন।
২০০১ সালে, ৮ বছরের বন্দিত্বের পর, তিনি জেলের কাপড়ধারী লন্ড্রি ট্রলির ভেতরে লুকিয়ে পালিয়ে যান। এই ঘটনার সময় জেলের অনেক কর্মীকে ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। এটি ছিল মেক্সিকোর ইতিহাসের অন্যতম লজ্জাজনক নিরাপত্তা ভাঙন।
দ্বিতীয়বার গ্রেফতার এবং ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক পালানো!
২০১৪ সালে এল চ্যাপো আবার ধরা পড়েন। এইবার তাঁকে রাখা হয় ‘Altiplano’ নামের সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত এক কারাগারে। কিন্তু তিনি আবারও দেখালেন, নিরাপত্তা মানেই সবকিছু নয়!
২০১৫ সালের জুলাই মাসে, তিনি রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যান একটি ১.৫ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গ দিয়ে, যা তাঁর সেলের বাথরুম থেকে শুরু হয়ে বাইরে একটি বাড়িতে গিয়ে উঠে। এই সুড়ঙ্গটি ছিল অত্যন্ত প্রযুক্তিনির্ভর – ভিতরে আলো, বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা এবং এমনকি মোটরসাইকেল ট্র্যাকও ছিল যাতে পালানোর গতি বাড়ানো যায়।
এই পালানোর পর পুরো বিশ্ব হতবাক হয়ে যায়। কিভাবে সম্ভব হলো এত সুরক্ষিত জেল থেকেও এমন পালানো? তদন্তে উঠে আসে, ভিতরের কিছু কর্মী এবং বাইরের পুরো একটি টিম এই সুড়ঙ্গ খননের পেছনে যুক্ত ছিল। এই ঘটনার পর মেক্সিকো সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ে এবং এল চ্যাপোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়।
তৃতীয়বার গ্রেফতার এবং আমেরিকায় প্রত্যর্পণ
২০১৬ সালে এল চ্যাপো আবার ধরা পড়ে এবং এইবার তাকে দ্রুত আমেরিকায় প্রত্যর্পণ করা হয়। কারণ মেক্সিকো আর কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। ২০১৯ সালে নিউইয়র্কে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয় এবং অবশেষে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। এখন তিনি আমেরিকার সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত কারাগার ‘ADX Florence’-এ বন্দি আছেন, যেখান থেকে পালানো প্রায় অসম্ভব।
এল চ্যাপোর প্রভাব ও কুখ্যাতি
এল চ্যাপো শুধু একজন মাদক সম্রাটই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মেক্সিকোর রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্নীতির প্রতীক। তাঁর জীবনের গল্প উঠে এসেছে বহু ডকুমেন্টারি, সিনেমা এবং সিরিজে – যেমন “El Chapo” ও “Narcos: Mexico।” তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যার নির্দেশে শত শত হত্যা, কোটি কোটি ডলার মাদক পাচার এবং পুলিশের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
শেষ কথা
এল চ্যাপোর গল্প একদিকে যেমন রোমাঞ্চকর, অন্যদিকে ভয়ংকর। এটি আমাদের শেখায়—কীভাবে দারিদ্র্য, দুর্নীতি এবং অপরাধের জগত একে অপরকে শক্তি জোগায়। তাঁর পালানোর ঘটনাগুলো যেন বাস্তবের চেয়ে কল্পকাহিনি বেশি মনে হয়, কিন্তু এগুলো সত্য। এল চ্যাপোর জীবন আমাদের দেখিয়ে দেয়, কৌশল, দুর্নীতি ও ভয়ংকর নেটওয়ার্ক মিললে কতটা ভয়ংকর প্রভাব ফেলতে পারে একজন মানুষ।
এই গল্পটি জানিয়ে যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা – শুধু জেল আর আইন দিয়ে অপরাধ দমন হয় না, দরকার পুরো সমাজের সঠিক কাঠামো এবং নৈতিকতার পুনর্গঠন।
এল চ্যাপো ছিল শুধু একজন মানুষ নয়, সে ছিল এক জীবন্ত রহস্য।
এমনই আরো অবিশ্বাস্য রহস্য নিয়ে যুক্ত থাকো "রহস্যগ্রহ"-এর সঙ্গে।
নতুন নতুন অজানা ও গোপন সত্যের দরজা খুলে দেবে আমাদের প্রতিটি গল্প!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন