আলকাট্রাজ: ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় পালানোর গল্প
"পাহাড়, জল আর শৃঙ্খল — এ তিনের মাঝখানে আটকে থাকা এক বন্দিশালা, নাম তার আলকাট্রাজ।"
আলকাট্রাজ শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি ভয়ঙ্কর, নিরাপত্তায় সুসজ্জিত কারাগার, যেখানে ঢোকা যায়, কিন্তু বের হওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ১৯৬২ সালের এক রাতে, ইতিহাস যেন নিজেই তার নিয়ম ভেঙে ফেলে — তিনজন কয়েদি, ফ্র্যাঙ্ক মরিস এবং অ্যাংলিন ভাইরা (জন ও ক্ল্যারেন্স), পালিয়ে যান এই দুর্গের মতো বন্দিশালা থেকে।
তাদের পালানোর কাহিনী এতটাই বিস্ময়কর যে আজও সেটি নিয়ে গবেষণা হয়, ডকুমেন্টারি তৈরি হয়, আর প্রশ্ন রয়ে যায় — ওরা কি সত্যিই বেঁচে পালাতে পেরেছিল?
চলো, আমরা ফিরে যাই ৬০ বছরেরও বেশি পেছনে, সেই রাতে, সেই ছক, সেই সাহস, আর সেই রহস্যময় যাত্রায়।
আলকাট্রাজ: যে জেল কোনো ছাড় দেয় না
আলকাট্রাজ ছিল ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো বে-তে একটি দ্বীপে অবস্থিত এক উচ্চ-নিরাপত্তার জেলখানা। ১৯৩৪ সালে এটি ফেডারেল জেল হিসেবে কাজ শুরু করে এবং সেখানে পাঠানো হত সবচেয়ে বিপজ্জনক ও পালানোর চেষ্টা করা অপরাধীদের।
এর ঘন কংক্রিটের দেয়াল, সশস্ত্র প্রহরী, শক্তিশালী লোহার দরজা, এবং চারপাশের বরফঠান্ডা সমুদ্র যেন এক কথায় বলে দিত — "এখান থেকে কেউ পালাতে পারবে না।"
কিন্তু “অসম্ভব” কথাটা সবসময় সবাই মানে না। কিছু মানুষ থাকে, যারা নিজের জীবন বাজি রেখে প্রমাণ করে দেয় — চাইলেই কিছুই অসম্ভব না।
ফ্র্যাঙ্ক মরিস: এক মেধাবী অপরাধী
ফ্র্যাঙ্ক মরিসের জীবনযাপন ছিল খুব ছোটবেলা থেকেই কঠিন। বাবা-মা ছিল না, আশ্রয়হীন অবস্থায় বড় হয়েছেন, আর তারপরে একটার পর একটা চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি মামলায় জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু মরিস ছিলেন প্রচণ্ড বুদ্ধিমান। তাঁর IQ ছিল ১৩৩ — অর্থাৎ গড় মানুষের চেয়েও অনেক বেশি।
এরকম একজন অপরাধী যখন আলকাট্রাজে পৌঁছান, তখনই কর্মকর্তারা বুঝে ফেলেন, তিনি সাধারণ কয়েদি নন।
অ্যাংলিন ভাইরা: একসাথে আসা, একসাথে পালানো
জন ও ক্ল্যারেন্স অ্যাংলিন, দুই ভাই, ফ্লোরিডা থেকে আসা। ছোটবেলা থেকেই ব্যাংক ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ে। তারা ছিল অতীতে একাধিকবার পালানোর চেষ্টা করা কয়েদি। শেষমেশ তাদের পাঠানো হয় আলকাট্রাজে — কারণ এখান থেকে পালানো "অসম্ভব।"
কিন্তু ওরা এসেছিল চোখে স্বপ্ন নিয়ে, আর মনেপ্রাণে বিশ্বাস নিয়ে যে, "অসম্ভব" বলে কিছু নেই।
পরিকল্পনার সূচনা: সব কিছু বদলে দেওয়া এক ছক
১৯৬০ সালে এই তিন কয়েদি আলাপ করে এবং তাদের সাথে আরও এক কয়েদি যুক্ত হয় — অ্যালেন ওয়েস্ট। তারা চারজন মিলে শুরু করেন এক চরম ঝুঁকিপূর্ণ পরিকল্পনা।
প্রথমেই তারা বুঝে ফেলেন, আলকাট্রাজের দেয়াল ভেদ করা যাবে না, কিন্তু পেছনের বায়ুচলাচলের ভেন্টের রাস্তা দিয়ে সম্ভব হতে পারে কিছু। এরপর তারা চার মাস ধরে প্রতিদিন খালি হাতে, কখনও চামচ দিয়ে, কখনও কাঠের টুকরা দিয়ে খুড়তে থাকেন তাদের নিজেদের সেলের পেছনের দেয়াল।
কিন্তু শুধু দেয়াল খুঁড়ে রাস্তা বানালেই হবে না। দরকার হবে একটি ভেলা — সমুদ্র পার হওয়ার জন্য। এখানেই আসে সৃষ্টিশীলতা।
রাবারের ভেলা, নকল মাথা আর রাতের অন্ধকার
তারা রাতের পর রাত ধরে কারখানা থেকে পাওয়া রেইনকোট কেটে, সেলাই করে বানাতে থাকে এক ধরনের রাবারের ভেলা। সাথে বানায় কাঠের প্যাডেল। সব গোপনে — দিনের বেলায় না, বরং রাতের গভীরে, অন্য কয়েদিরা ঘুমিয়ে পড়ার পরে।
আর নকল মাথা? হ্যাঁ! তারা নিজের বিছানায় রাখে প্লাস্টার, সাবান, কাগজ, আর মানুষের চুল দিয়ে বানানো মূর্তি — যেন প্রহরীরা দেখে ভাবে তারা ঘুমাচ্ছে।
এ একেবারে সিনেমার মতোই — কিন্তু সব সত্যি।
১৯৬২ সালের ১১ই জুন: সেই রাতে যা ঘটেছিল
রাত নটা নাগাদ প্রতিটি কয়েদি সেলেই ছিল। প্রহরীরা রাউন্ডে এসে দেখে, সবাই ঘুমোচ্ছে। কিন্তু সবার নজর এড়িয়ে, মরিস ও অ্যাংলিন ভাইরা তাদের সেলের পেছনের ছোট গর্ত দিয়ে গোপনে বের হয়ে যান দেয়ালের ভিতর দিয়ে।
ওরা উঠে যায় জেলের ছাদে, তারপর নামেন ভেন্টিলেশন পাইপ ধরে নিচে, তারপর পেছনের দেয়াল পেরিয়ে চলে যান তীরে।
সেখানে তারা তাদের বানানো রাবারের ভেলা দিয়ে শুরু করেন সমুদ্র পার হওয়ার ভয়ানক চেষ্টা — গন্তব্য: সান ফ্রান্সিসকো উপকূল।
সকালে কি পাওয়া যায়?
সকালে যখন রুটিন চেক করা হয়, তখনই ধরা পড়ে যায় — বিছানায় যে মাথা রাখা ছিল, তা আসলে নকল। সঙ্গে সঙ্গে পুরো জেলখানায় হইচই পড়ে যায়।
সার্চ অপারেশন চালানো হয়। হেলিকপ্টার, নৌকা, সাঁতারু দল — সবাই ঘন্টার পর ঘন্টা তল্লাশি চালায়।
কিন্তু... কোথাও কিছুই পাওয়া যায় না।
একজন, অ্যালেন ওয়েস্ট, পালাতে পারেননি — তার গর্ত পুরোভাবে শেষ হয়নি। সে সব খুলে বলে, কিভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু মরিস ও অ্যাংলিন ভাইদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
তারা কি সত্যিই বেঁচে গিয়েছিল?
এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন — তারা কি বেঁচে ছিল? নাকি বরফঠান্ডা সান ফ্রান্সিসকো উপসাগরের জলে ডুবে গিয়েছিল?
FBI প্রায় ১৭ বছর ধরে তদন্ত চালায়। কখনও একেক জায়গায় রাবারের টুকরা, কখনও এক ভাইয়ের মায়ের কাছে আসা এক রহস্যময় কার্ড — নানা সূত্র উঠে আসে, কিন্তু কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়।
২০১৩ সালে এক চিঠি আসে — বলা হয় সেটি জন অ্যাংলিন লিখেছে। সেখানে বলা হয়, তারা তিনজনই বেঁচে গিয়েছিল, কিন্তু এখন ক্যানসারে ভুগছে, আত্মসমর্পণ করতে চায়। কিন্তু সেই চিঠির সত্যতা কখনো প্রমাণ হয়নি।
আলকাট্রাজ এখন কী?
১৯৬৩ সালে, অর্থনৈতিক কারণে ও নিরাপত্তা উন্নয়নের অভাবে, আলকাট্রাজ জেল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন এটি একটি মিউজিয়াম — যেখানে লাখ লাখ পর্যটক আসেন প্রতিবছর।
আর সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ? ফ্র্যাঙ্ক মরিস ও অ্যাংলিন ভাইদের পালানোর সেই সেল, সেই ছিদ্র, সেই ছাদ — যা আজও বলে যায়, মানুষের সাহস আর মেধা যদি এক হয়, তবে কিছুই অসম্ভব নয়।
শেষকথা: কাহিনী না ইতিহাস?
এই গল্প কাহিনী নয় — এটি ইতিহাস। তবে ইতিহাসের ভেতরেও আছে কাহিনীর মতো টানটান উত্তেজনা, সাহস আর রহস্য। ফ্র্যাঙ্ক মরিস, জন ও ক্ল্যারেন্স অ্যাংলিন আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে “অসম্ভব” শব্দটার মানে বদলে যায় মানুষের অদম্য মনোবলের সামনে।
তাদের শেষ পরিণতি আজও অজানা, কিন্তু তারা চিরকাল রয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায় — সেই কয়েদি হিসেবে, যারা একবার সত্যিই “অসম্ভব” কে হার মানিয়েছিল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন