TOI-715: নাসার আবিষ্কৃত পৃথিবীর মতো নতুন গ্রহ!



 TOI-715: নাসার নতুন সৌরজগত আবিষ্কার – পৃথিবীর মতো এক গ্রহের সন্ধানে!

বর্তমান সময়ে মানুষ মহাকাশের রহস্য ভেদ করার জন্য যে অদম্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তার এক অনন্য প্রমাণ হলো নাসার সাম্প্রতিক আবিষ্কার – TOI-715 নামের একটি নতুন সৌরজগত। এটি এমন এক সিস্টেম, যার ভেতরে থাকা একটি গ্রহ TOI-715 b বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুমুল কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। কেননা এই গ্রহটিকে পৃথিবীর ‘সদৃশ’ বলা হচ্ছে — অর্থাৎ এখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে!

কিন্তু কীভাবে এই গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেল? এই সৌরজগতের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যই বা কী? TOI-715 b-কে এত বিশেষ করে তুলল কোন বিষয়গুলো? আর এই আবিষ্কার আমাদের ভবিষ্যৎ অনুসন্ধানের জন্য কী বার্তা দেয়? আজ আমরা জানব TOI-715 সিস্টেমের পেছনের চমকপ্রদ বিজ্ঞান, এবং কীভাবে এই ক্ষুদ্র একটি গ্রহ হয়তো একদিন আমাদের ভবিষ্যতের বাসস্থান হয়ে উঠতে পারে।


TOI-715 কী?

TOI বলতে বোঝায় TESS Object of Interest – অর্থাৎ এটি সেই সব তারার তালিকা, যেগুলোর চারপাশে সম্ভাব্য গ্রহ ঘুরছে বলে ধারণা করা হয় এবং যেগুলোকে TESS (Transiting Exoplanet Survey Satellite) দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

TOI-715 হলো এমনই এক নক্ষত্র, যা পৃথিবী থেকে প্রায় ১৩৭ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটি একটি লাল বামন (Red Dwarf) বা M-dwarf টাইপের তারকা, যা সূর্যের তুলনায় আকারে ছোট এবং অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বল। কিন্তু এই নক্ষত্রটির চারপাশেই আবর্তিত হচ্ছে একটি সম্ভাব্য ‘হ্যাবিটেবল’ গ্রহ – TOI-715 b


TOI-715 b: পৃথিবীর মতো এক সম্ভাব্য গ্রহ

নাসার বিজ্ঞানীরা TOI-715 b নামের এই গ্রহটিকে একটি সুপার আর্থ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর অর্থ হলো, এর ভর ও আকার পৃথিবীর চেয়ে বেশি হলেও, এটি এখনো শক্ত মাটির গ্রহ – গ্যাস জায়ান্ট নয়।

TOI-715 b-এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

  • আকার: পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১.৫ গুণ বড়

  • অক্ষরেখায় অবস্থান: এটি তার নক্ষত্রের হ্যাবিটেবল জোনে অবস্থান করে – অর্থাৎ এমন দূরত্বে, যেখানে জল তরল অবস্থায় থাকতে পারে

  • কক্ষপথ: মাত্র ১৯ দিনে এটি তার নক্ষত্রকে একবার প্রদক্ষিণ করে

  • প্রশ্ন উঠছে: এমন ঘনিষ্ঠ কক্ষপথেও কি এটি জীবন ধারণের জন্য উপযুক্ত?


কীভাবে এই গ্রহটি খুঁজে পাওয়া গেল?

TOI-715 b আবিষ্কৃত হয়েছে NASA-এর TESS (Transiting Exoplanet Survey Satellite) মিশনের মাধ্যমে। TESS মূলত রাতের আকাশে থাকা হাজার হাজার তারাকে পর্যবেক্ষণ করে, এবং কোন তারার আলো সাময়িকভাবে কমে গেলে তা বিশ্লেষণ করে গ্রহ আবিষ্কারের চেষ্টা করে।

এই পদ্ধতিকে বলা হয় Transit Method — যেখানে একটি গ্রহ যদি তার নক্ষত্রের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, তাহলে নক্ষত্রের আলো সাময়িকভাবে কমে যায়। এই মৃদু আলোর পরিবর্তনের বিশ্লেষণ করেই TOI-715 b-এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।


TOI-715 b-এর আবহাওয়া ও জীবন ধারণযোগ্যতা

বিজ্ঞানীদের আগ্রহের মূল কারণ হলো, TOI-715 b এমন দূরত্বে রয়েছে যেখানে তাপমাত্রা খুব সম্ভবত তরল জলের জন্য উপযুক্ত। যদিও এর কক্ষপথ মাত্র ১৯ দিনের, এর নক্ষত্রটি যেহেতু একটি লাল বামন এবং অনেক কম শক্তি নির্গত করে, তাই এটি এত কাছাকাছি থেকেও সম্ভবত অতিরিক্ত উত্তপ্ত নয়।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এটি কি tidally locked? অর্থাৎ এই গ্রহের এক পাশ সবসময় আলোয় থাকে, আর অন্য পাশ চির অন্ধকার? এমন হলে, সারা গ্রহে একসমান পরিবেশ গঠিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

বিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছেন এর বায়ুমণ্ডলের তথ্য বিশ্লেষণ করতে, যাতে জানা যায় সেখানে অক্সিজেন, জলীয়বাষ্প বা মিথেনের মতো উপাদান আছে কিনা।


আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য – দ্বিতীয় গ্রহের সম্ভাবনা!

সম্প্রতি এমনও আভাস পাওয়া গেছে যে TOI-715 সিস্টেমে দ্বিতীয় একটি ছোট গ্রহ থাকতে পারে – এবং সেটি হতে পারে একেবারে পৃথিবীর আকারের! যদিও এখনো এটি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি, তবে এমন হলে এই সিস্টেমটি হতে পারে দুটি পৃথক হ্যাবিটেবল জোন বিশিষ্ট এক বিরল সৌরজগত!


TOI-715 আমাদের ভবিষ্যতের জন্য কী বার্তা দেয়?

TOI-715-এর মতো গ্রহ খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন যে, আমাদের আকাশগঙ্গার অনেক ছোট ছোট নক্ষত্রের আশেপাশেই জীবনধারণযোগ্য পৃথিবীর মতো গ্রহ লুকিয়ে থাকতে পারে। এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো – এরকম গ্রহ আমরা বর্তমান প্রযুক্তি দিয়েই খুঁজে পেতে পারছি

এটি ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। James Webb Space Telescope-এর মতো পরবর্তী প্রজন্মের টেলিস্কোপ দিয়ে এই গ্রহের আবহমণ্ডলের রসায়ন বিশ্লেষণ করে জানা সম্ভব হবে—সত্যিই কি এখানে প্রাণ থাকতে পারে?


গ্রহ সন্ধানে নাসার অবদান

নাসার TESS মিশন হচ্ছে Kepler-এর পরবর্তী ধাপ। এটি ২০১৮ সালে মহাকাশে পাঠানো হয়, যার উদ্দেশ্য হলো সমগ্র আকাশ জুড়ে সম্ভাব্য এক্সোপ্ল্যানেট (পৃথিবীর বাইরের গ্রহ) খুঁজে বের করা।

এ পর্যন্ত TESS ৭০০০+ সম্ভাব্য গ্রহ চিহ্নিত করেছে, যাদের মধ্যে অনেকগুলো এখন গবেষণার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে। TOI-715 b তেমনই একটি আকর্ষণীয় গ্রহ, যার গবেষণায় হয়তো একদিন আমরা অন্য পৃথিবীর হদিস পেয়ে যাব!


বিজ্ঞানীদের আশা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

TOI-715 b এখন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, খুব শিগগিরই James Webb Telescope এই গ্রহের আলো বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবে এর বায়ুমণ্ডলের গঠন কেমন।

যদি সেখানে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস পাওয়া যায়—তাহলে এটি হবে ইতিহাসে এক চমকপ্রদ মুহূর্ত!
আর যদি এই গ্রহ সত্যিই জীবনের জন্য উপযুক্ত হয়, তাহলে এই প্রজন্মের মানুষের জীবনেই আমরা হয়তো দেখতে পাব অন্য একটি পৃথিবী!


উপসংহার: TOI-715 আমাদের স্বপ্নের এক জানালা

মহাকাশ সবসময়ই মানুষের কল্পনা ও কৌতূহলের কেন্দ্র। TOI-715 এবং তার পৃথিবীসদৃশ গ্রহ TOI-715 b আমাদের সেই চিরন্তন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করছে—“আমরা কি একা?”

এই নতুন সৌরজগতের আবিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে যে, জীবনের সম্ভাবনা কেবল পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ নয়। ভবিষ্যতে, হয়তো আমরা এরকম আরও অনেক সৌরজগত খুঁজে পাবো, যেখান থেকে উঠে আসবে নতুন প্রাণ, নতুন সভ্যতার গল্প।

TOI-715 তাই শুধুমাত্র একটি বিজ্ঞান ঘটনা নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ কল্পনার অন্যতম ভিত্তি। সেই স্বপ্ন, যেখানে মানুষ একদিন পৃথিবীর বাইরেও বসবাস করবে, নতুন দিগন্তে জীবন গড়ে তুলবে। TOI-715 আমাদের সেই স্বপ্নের পথ দেখাচ্ছে—ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে শুধু।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন