গুইসাপ আর সান্দা নিয়ে বিভ্রান্তি: বাস্তবতা, বৈজ্ঞানিক তথ্য ও সামাজিক গুজবের পর্দা ফাঁস

গুইসাপ আর সান্দা – দুটি নাম, এক রহস্য


সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আপনি হয়তো এমন অনেক ভিডিও দেখেছেন যেখানে এক বিশাল সরীসৃপ প্রাণীকে মানুষ ধাওয়া করছে, ধরে ফেলছে বা বিক্রি করছে “তেল” বের করার জন্য। কোথাও বলা হচ্ছে, এই তেল নাকি “পুরুষত্ব বৃদ্ধি করে”! কেউ এটিকে গুইসাপ বলছে, কেউ আবার সান্দা। কিন্তু আদতে এই প্রাণীগুলোর পরিচয় কী? গুইসাপ ও সান্দা কি এক প্রাণী? নাকি সম্পূর্ণ ভিন্ন?


এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই আমরা আজ জানবো—এই দুই প্রাণীর আসল পরিচয়, পার্থক্য, গুজবের উৎপত্তি, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আইনগত বিষয়।


গুইসাপ: প্রকৃতির শক্তিশালী এক সদস্য


গুইসাপের ইংরেজি নাম Monitor Lizard, যার বৈজ্ঞানিক নাম Varanus bengalensis। এরা বড় আকারের সরীসৃপ, দৈর্ঘ্যে ৪ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত হয়। গুইসাপের পা শক্তিশালী, লেজ লম্বা ও মোটা এবং এদের জিভ দ্বিখণ্ডিত, অনেকটা সাপের মতো।


এরা মূলত মাংসাশী, অর্থাৎ পোকামাকড়, ছোট প্রাণী, সাপ এবং ডিম খেয়ে বাঁচে। এদের উপস্থিতি কৃষিকাজের জন্য উপকারী—কারণ তারা ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় ও সাপের ডিম খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।


সান্দা: নিরীহ তৃণভোজী প্রাণী


অন্যদিকে, যাকে সাধারণ মানুষ "সান্দা" বলে ডাকে, তার প্রকৃত পরিচয় Spiny-tailed Lizard, বৈজ্ঞানিক নাম Uromastyx hardwickii। এটি আকারে ছোট (১-২ ফুট) এবং এর লেজে থাকে স্পাইক বা খাঁজযুক্ত অংশ।


সান্দা তৃণভোজী, অর্থাৎ এটি গাছের পাতা, শাকসবজি, বীজ ইত্যাদি খেয়ে বাঁচে। এটি ধীর গতির এবং একেবারেই নিরীহ প্রকৃতির।


গুইসাপ বনাম সান্দা: পার্থক্য কোথায়?


বৈশিষ্ট্য

                                     গুইসাপ                                                 


বৈজ্ঞানিক নাম :     Varanus bengalensis                   

খাদ্যাভ্যাস :                মাংসাশী                                       

আকার         :           বড় (৪-৬ ফুট)                              

গতি                 :                     দ্রুত                                           

স্বভাব         :     মাঝেমাঝে আক্রমণাত্মক       

লেজ        :           লম্বা ও শক্তিশালী                      



                              সান্দা



বৈজ্ঞানিক নাম:     Uromastyx hardwickii

খাদ্যাভ্যাস :               তৃণভোজী

আকার         :          ছোট (১-২ ফুট)

গতি                 :              ধীর

স্বভাব         :     পুরোপুরি নিরীহ

লেজ        :          ছোট ও স্পাইকি



তবে সমস্যা হলো—মানুষ এই দুই প্রাণীকে প্রায়শই গুলিয়ে ফেলে। সোশ্যাল মিডিয়ার ভুল তথ্যে অনেকে ভাবে দুইটিই একই, ফলে উভয় প্রাণীই শিকার হচ্ছে নির্মমতার।


“সান্দার তেল” – গুজব না সত্য?


সবচেয়ে বহুল প্রচলিত গুজব হলো, সান্দার তেল পুরুষত্ব বা যৌন ক্ষমতা বাড়ায়। এই মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে কয়েক দশক ধরে, বিশেষ করে ভারতের উত্তরাঞ্চল, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে। বলা হয়, সান্দাকে জীবন্ত আগুনে ফেলে যে তেল বের হয়, তা খেলে পুরুষের শক্তি বাড়ে।


বাস্তবতা হলো—এই দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, হোমিওপ্যাথি বা হারবাল চিকিৎসা পদ্ধতির কোথাও এ তেলের কার্যকারিতা প্রমাণিত নয়।


এই গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে কিছু অসাধু তেল বিক্রেতা এবং কথিত হাকিমরা, যারা অর্থের লোভে নিরীহ প্রাণীগুলোকে হত্যা করছে। ফলে, দিন দিন এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে।


গুইসাপ নিয়েও প্রচলিত কিছু মিথ


গুইসাপ সম্পর্কে অনেকেই মনে করেন—এটি মানুষের পেছনে তাড়া করে, এমনকি কেউ কেউ একে সাপের আত্মীয় বলে মনে করে। বাস্তবে গুইসাপ মানুষকে এড়িয়ে চলে। হুমকি অনুভব করলে আত্মরক্ষার্থে কামড় দিতে পারে, তবে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণ করে না। তাদের চেহারা ভয়ানক হলেও তারা আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


প্রাকৃতিক পরিবেশে গুইসাপ ও সান্দার ভূমিকা


গুইসাপ পোকামাকড় ও সাপ খেয়ে ফসল রক্ষা করে।

সান্দা গর্ত করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং বীজ ছড়িয়ে নতুন গাছ জন্মাতে সাহায্য করে।

তাদের অস্তিত্ব হারালে, পরিবেশের একেকটি ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে।


আইন কী বলে?


বাংলাদেশ ও ভারতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, গুইসাপ ও সান্দা উভয়ই সংরক্ষিত প্রাণী। তাদের হত্যা, শিকার, বিক্রি বা পাচার করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। দোষী ব্যক্তি জরিমানা ও কারাদণ্ডের সম্মুখীন হতে পারেন।


কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অধিকাংশ মানুষ এসব আইনের ব্যাপারে অবগত নয়। তাদের অজ্ঞতা ও গুজবের কারণে এই প্রাণীগুলো আজ বিলুপ্তির পথে।


সোশ্যাল মিডিয়া ও ভুয়া কনটেন্টের প্রভাব


আজকাল কেউ একটা ভিডিও বানিয়ে বলে দেয়—“এই সান্দার তেল মহৌষধ!”—আর সঙ্গে সঙ্গে তা ভাইরাল। আবার কেউ গুইসাপ ধরে বলে—“মানুষ খেয়ে ফেলে!” অথচ এসব ভিডিওর ৯০%-ই ভুয়া, নাটকীয় ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।


এ ধরনের ভুয়া কন্টেন্ট শুধু প্রাণীদের ক্ষতি করছে না, সমাজে বিভ্রান্তি ও ভয় ছড়াচ্ছে। কিছু অসাধু চক্র এই বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে প্রাণী পাচার করে বিপুল লাভ করছে।


সমাধান কোথায়?


আমরা যদি সচেতন হই, গুজবে কান না দিই এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসি—তবে এসব প্রাণীকে রক্ষা করা সম্ভব।

প্রতিটি প্রাণী, যত ছোট বা অচেনা হোক না কেন, এই পৃথিবীর একেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা বেঁচে থাকলে আমাদের পরিবেশও বেঁচে থাকবে।


শেষ কথা:

আসুন, আমরা তথ্য যাচাই করি, গুজবের পিছনে না ছুটে বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করি। প্রকৃতিকে ভালোবাসি, আর প্রতিটি জীবের প্রতি সহানুভূতিশীল হই। আমাদের সচেতনতাই পারে এই পৃথিবীকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবিক করে তুলতে।


এই ব্লগটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুন এবং আমাদের ওয়েবসাইট rohosshogroho.com ভিজিট করুন আরও এমন তথ্যবহুল কনটেন্টের জন্য।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন