ধরুন, আপনি সন্ধ্যার পর একটা পাহাড়ি গ্রামের দিকে হাঁটছেন। চারপাশে নীরবতা, ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন—সূর্য এখনও মাথার ওপরে! রাত ১১টা বাজলেও চারপাশ যেন দুপুর ১২টার মতোই উজ্জ্বল!
এটা কি স্বপ্ন? নাকি কোনো বৈজ্ঞানিক ভুল? না, এটা একেবারে সত্য। পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে রাতেও সূর্যের আলো দেখা যায়। এই অসাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনাকে বলা হয় Midnight Sun বা মধ্যরাতের সূর্য।
Midnight Sun কী?
Midnight Sun এমন একটি ঘটনা যেখানে রাত ১২টা বা তার আশেপাশেও সূর্য আকাশে দেখা যায়, এবং অন্ধকার নামে না। এটা পৃথিবীর নির্দিষ্ট কিছু উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে ঘটে, সাধারণত গ্রীষ্মকালে।
এই ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় উত্তর মেরুর কাছাকাছি দেশগুলোতে যেমন:
নরওয়ে (Norway)
আলাস্কা (Alaska, USA)
আইসল্যান্ড (Iceland)
সুইডেন (Sweden)
কানাডার উত্তরাংশ (Northern Canada)
ফিনল্যান্ড (Finland)
রাশিয়ার কিছু অংশ
নরওয়েতে তো একে বলা হয় “Land of the Midnight Sun”, কারণ দেশের একেবারে উত্তর দিকে প্রায় ৭৬ দিন সূর্য ডুবে না!
এটা কীভাবে সম্ভব?
এই রহস্যের পেছনে রয়েছে পৃথিবীর কাত হওয়া অক্ষ (tilted axis) এবং তার কক্ষপথে ঘোরার ধরন।
পৃথিবী তার অক্ষের সাথে প্রায় ২৩.৫ ডিগ্রি কাত হয়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই কারণে বছরে ছয় মাস করে উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে আলাদা আলাদা ভাবে দিন বড় হয় এবং রাত ছোট।
উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল (মে-জুলাই) – তখন উত্তর মেরুর কাছাকাছি অঞ্চলগুলোতে সূর্য একেবারেই অস্ত যায় না।
দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল (নভেম্বর-জানুয়ারি) – তখন ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটে অ্যান্টার্কটিকার কাছাকাছি অঞ্চলগুলোতে।
মানুষ কেমন করে মানিয়ে নেয়?
এমন অবস্থা যেখানে রাতেও দিন থাকে, মানুষের শরীরের ঘুমের সময়, মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণ, এবং দৈনন্দিন রুটিন সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। তাই সেখানকার মানুষ ঘুমানোর জন্য ভারী পর্দা, চোখ ঢাকার মাস্ক, এবং আলোক-নিয়ন্ত্রিত ঘর ব্যবহার করে।
শুধু তাই নয়, শিশুদের ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলতেও কিছুটা কষ্ট হয় কারণ বাইরের আলো দেখে তারা মনে করে এখনো দিন।
পর্যটকদের কাছে এক বিস্ময়!
প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক Midnight Sun দেখার জন্য এসব অঞ্চলে ছুটে যান। তারা এমন সময় বেছে নেয় যখন রাত ১০টা-১১টা বেজে গেলেও হাইকিং, কায়াকিং বা আলোকচিত্র তোলার মত কাজ করা যায়।
বিশেষ করে নরওয়ের Tromsø, ফিনল্যান্ডের Lapland, ও আলাস্কার Fairbanks এই অভিজ্ঞতার জন্য বিখ্যাত।
এই ঘটনা কি বিপদজনক?
না, Midnight Sun নিজে কোনো বিপদ সৃষ্টি করে না। তবে দীর্ঘসময় আলো থাকলে ঘুমের ব্যাঘাত, মানসিক চাপ, এবং অবসাদ দেখা দিতে পারে। এজন্য সেখানে বসবাসকারী মানুষদের ঘুমের সময় ও রুটিন নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু কল্পকাহিনী ও সংস্কারও আছে:
অনেক প্রাচীন সমাজে মনে করা হতো, এই সূর্য দেবতার আশীর্বাদ, যারা আলো দিয়ে অন্ধকারকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলত, এটি ভবিষ্যতের বার্তা, যেটা কোনো বিশেষ পরিবর্তনের সংকেত।
তবে আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলেন—এই পুরো ঘটনাটি আসলে পৃথিবীর নিজস্ব কক্ষপথের গাণিতিক ফলাফল।
শেষ কথা:
Midnight Sun পৃথিবীর এক অনন্য রহস্য, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই গ্রহে এখনো অনেক কিছু আছে জানার, দেখার এবং বিস্ময়ের। রাতের আঁধারে সূর্যের আলো যেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়, ঠিক তেমনি এই ঘটনা আমাদের শেখায়, প্রকৃতির সামনে আমরা এখনও কতটা অজানা।
আপনি যদি একদিন কখনো নরওয়ের দিকে যান, তাহলে হয়তো আপনার ঘড়িতে রাত ১২টা বাজবে, আর আকাশে তখনো সূর্য জ্বলবে! সেই মুহূর্তটা হতে পারে আপনার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা।
এইরকম আরও বৈজ্ঞানিক রহস্য, মহাকাশের অজানা গল্প, আর পৃথিবীর অদ্ভুত জায়গার কাহিনি জানতে আমাদের চ্যানেল/ব্লগ ‘রহস্যগ্রহ (Rohosshogroho)’ ফলো করুন। আপনার মতামত কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না, আর পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন